বিজয়ের পঞ্চাশে সেরা ৫

বিজয়ের ৫০ বছরে আজ বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাফল্য আজ ঈর্ষণীয়। একের পর এক সাফল্যে বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয় বরং উন্নয়নের রোল মডেল। বিজয়ের পঞ্চাশে সেরা অর্জন নিয়েই এই প্রতিবেদন।

পদ্মা সেতু:

স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এক সময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে। পদ্মা সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের আবেগ। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আর্ন্তজাতিক আরও তিনটি সংস্থা- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জা'পান ইন্টারন্যাশনাল কো-অ'পারেশন এজেন্সি এবং ইস'লামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতে পদ্মা'র আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। পরের ইতিহাস সবার জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এতেই কে'টে যায় কালো মেঘ, দিগন্ত আলোকিত করে হেসে উঠে সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে ধ'রা দিচ্ছে।

পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। সেতুকে ঘিরেই মানুষের জীবনযাত্রার মানও বদলাচ্ছে। এখানে বিশ্বমানের অলিম্পিক ভিলেজ, বেনারসি তাঁতপল্লী, রাজউকের উদ্যোগে আইকন টাওয়ার, দেশের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১:

২০১৮ সালের ১২ মে উৎক্ষেপণ করা হয় বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। যু'ক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয় এই স্যাটেলাইট। এটির নামকরণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এই স্যাটেলাইট স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে টেলিযোগাযোগ স্থাপন, নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রচার সেবা নিশ্চিত করা। প্রাকৃতিক দু'র্যোগের সময় ফাইবার অ'পটিক নেটওয়ার্ক বা ট্রান্সমিশন টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন ব্যাহত না হয়। এর মধ্য দিয়ে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয় বাংলাদেশের নাম।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ১৬০০ মেগাহার্জ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০টি কে-ইউ এবং সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করে এবং এটির আয়ু ধ'রা হয়েছে ১৫ বছরের মতো। স্যাটেলাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রঙের নকশার ওপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে।

‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’টির কে-ইউ ব্যান্ডের আওতায় রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরে তার জলসীমাসহ ভা'রত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল। বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের ভূকেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ জন্য গাজীপুর জে'লার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূকেন্দ্র তৈরি করা হয়। জয়দেবপুরের ভূকেন্দ্রটি হলো মূল স্টেশন। আর বেতবুনিয়ায় স্টেশনটি বিকল্প হিসেবে রাখা হয়। শুধু দেশি সংস্থা নয়, বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে হন্ডুরাস, তুরস্ক, ফিলিপাইন, ক্যামেরুন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০২৩ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপনের লক্ষ বাংলাদেশের।

মেট্রোরেল:

সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম মেট্রোরেল এখন আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরের আগ্রগতির অন্যতম এক উদাহ'রণ ঢাকা মেট্রোরেল। ঢাকার এলিভেটেড মেট্রোরেল বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। যাত্রী পরিবহনের নতুন এই ধরন দেশের মাটিতে আগে কখনো দেখা যায়নি। দেশের পরিবহন খাতের জন্য এটা বড় ঘটনা। বাংলাদেশের মতো একটি অধিক জনবহুল, দ্রুত নগরায়ন হতে থাকা ও জায়গার স্বল্পতায় ধুঁকতে থাকা একটি দেশের জন্য মেট্রো রেলের সুবিধা অনেক। এটা যে কেবল দৈনিক যাতায়াতের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনবে, তা না। বরং একসঙ্গে প্রচুর সংখ্যক যাত্রীবহনের মাধ্যমে পরিবহনের অন্য মাধ্যমগুলোর ওপরও চাপ কমিয়ে দেবে।

এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধ'রা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জা'পান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে।

২০৩০ সালের মাধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সব কয়টি লাইনের কাজ সম্পন্ন হলে রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে স'ন্দেহ নেই। অসহনীয় যানজট থেকেও মুক্ত হবে নগরবাসী।

কর্ণফুলী টানেল:

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে দুই টিউববিশিষ্ট বহু লেনের কর্ণফুলী টানেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের এ টানেল সংযু'ক্ত করবে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা ও দক্ষিণের আনোয়ারা প্রান্তকে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে রোড টানেলটি হবে চার লেনের। টুইন টিউব টাইপের মূল টানেলের দৈর্ঘ হবে ৩.৩১৫ কিলোমিটারের বাইরে পতেঙ্গা প্রান্তে ৫৫০ মিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার।

এই টানেল নির্মাণের ফলে পণ্যসেবা ও জ্বালানির বাজার প্রবেশগম্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি অশুল্ক বাধা দূর হবে। বাণিজ্য সহ'জীকরণ ত্বরান্বিত করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং খনিজদ্রব্য পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ উত্তোলন ও উন্নয়ন সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম নগরীতে নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়নেও ভুমিকা পালন করবে এই টানেল।

এই টানেল নির্মাণের আরও কিছু উদ্দেশ হল চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রামকেও ‘ওয়ান সিটি’ অ্যান্ড টু টাউনের আদলে গড়ে তোলা, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আবর্তিত ব্লু ইউকোনমি সম'র্থন দেয়া, পরিবহন কেন্দ্রস্থল হিসেবে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক শহরকে আরো বেশি শক্তিশালী করা, কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি প্রসার ঘটানো, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান দুই সেতুুর ওপর থেকে যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনা, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান স্থানের সাথে কর্ণফুলী পূর্বপাশে নির্মীয়মাণ শহরের সংযোগ স্থাপন এবং উন্নয়ন কাজে গতি বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র:

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরিক'ল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা বাংলাদেশের পাবনা জে'লার ঈশ্বরদী উপজে'লার রূপপুর নামক স্থানে নির্মীত হচ্ছে। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যার প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ২’শ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাবনার ঈশ্বরদী উপজে'লার অন্তর্গতক পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে নির্মিত হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রকল্পটি পদ্মা নদীর উপরে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে অবস্থিত।

Back to top button